বাংলাদেশে গাড়ি বীমা সম্পর্কে ধারণাঃ কেনার আগে যা জানা জরুরি

যেকোনো অপ্রত্যাশিত ঝুঁকি থেকে আর্থিক সুরক্ষা পেতে বীমা একটি কার্যকর পলিসি। বাংলাদেশে যানবাহনের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, সেই সাথে সড়ক দুর্ঘটনাও বাড়ছে। গাড়ি কেনা একটি বড় ইনভেস্টমেন্ট, তাই গাড়ির কোনো দুর্ঘটনা হলে, আর্থিক ক্ষতির অঙ্কও বড় হয়। তাই অবশ্যই গাড়ির বীমা থাকা প্রয়োজন। দুর্ঘটনা, চুরি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহ বিভিন্ন ক্ষয়ক্ষতি, বীমার আওতায় রয়েছে। বীমা পলিসি আপনাকে একই সাথে আর্থিক সুরক্ষা দেবে এবং আইনি জটিলতা থেকে রক্ষা করবে।
বাংলাদেশে আইনি ও আর্থিক সুরক্ষার জন্য গাড়ির বীমা প্রয়োজনীয়। তবে অধিকাংশ গাড়ি মালিকের বীমা পলিসি নির্বাচন, কভারেজ লিমিট, প্রিমিয়ামের রেট কীভাবে নির্ধারিত হয়, এবং বিভিন্ন শর্তাবলি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণার অভাব রয়েছে। এই ব্লগে বাংলাদেশে গাড়ি বীমা সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়েছে। বীমা কেনার আগে যা যা জানা প্রয়োজন, সে বিষয়েও বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
গাড়ি বীমা কেনার আগে যেসব বিষয় খেয়াল করবেন
গাড়ির ধরন, ইঞ্জিন সিসি, ফুল ইনসিওর্ড ভ্যালু (এফআইভি), অ্যাড-অন, ড্রাইভিং রেকর্ড, কেমন পরিবেশে রেগুলার ড্রাইভ করেন, ড্রাইভারের বয়স, চালকের অভিজ্ঞতা, ইত্যাদি বিষয়ের উপর প্রিমিয়াম নির্ভর করে।
১. গাড়ি বীমার প্রকারভেদ
বাংলাদেশে গাড়ির বীমা প্রধানত দুই ধরনের, থার্ড পার্টি লায়াবিলিটি বীমা এবং কমপ্রিহেনসিভ বীমা। থার্ড পার্টি লায়াবিলিটি বীমা গাড়ির জন্য ন্যূনতম এবং বাধ্যতামূলক বীমা। এটি তৃতীয় পক্ষের অর্থাৎ অন্যান্য ব্যক্তি বা সম্পত্তির ক্ষতি, যেমন - সম্পত্তির ক্ষতি, মৃত্যু, গুরুতর আঘাত, ইত্যাদি ক্ষতি কভার করে। এক কথায়, এটি আপনার গাড়ির ক্ষতি কভার করে না, কিন্তু আপনার কারণে অন্যদের কোনো ক্ষতি হলে, সেই দাবি থেকে সুরক্ষা দেয়। যারা কম খরচে আইনি সুরক্ষা চান, তাদের জন্য এই পলিসি উপযোগী।
কমপ্রিহেনসিভ বীমা সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং কার্যকর। এটি নিজের গাড়ি এবং অন্য পক্ষ উভয়ের ক্ষতি কভার করে। দুর্ঘটনা, চুরি, আগুন, বিস্ফোরণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভাঙচুর, ইত্যাদি কারণে গাড়ির কোনো ক্ষতি হলে, এই বীমা পলিসি বীমাগ্রহীতাকে সরাসরি সুরক্ষা দেয়।
২. বীমা পলিসিতে কী কী কভারেজ পাবেন
দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতি, দুর্ঘটনাজনিত আগুন, চুরি-ডাকাতি, গাড়ির যন্ত্রাংশ চুরি, সহিংস কর্মকাণ্ডের ফলে ক্ষতি, বন্যার কারণে ক্ষতি, দুর্ঘটনায় আহত, ইত্যাদি ক্ষতিতে বীমার আওতায় সুরক্ষা পাওয়া যায়। এগুলো সব বিষয়ের মধ্যে শর্ত প্রযোজ্য থাকে। তাই, বীমা পলিসি এবং অ্যাড-অন বিষয়গুলো ভালোভাবে পড়ে নিতে হবে।
৩. গাড়ি বীমায় কী কী কভার করা হয় না
যান্ত্রিক বা ইলেকট্রিক্যাল সমস্যার কারণে গাড়ির কোনো ক্ষতি হলে, তা বীমার আওতায় পরে না। ইঞ্জিন, টায়ার, ব্যাটারি, ইত্যাদি সমস্যা হলে বীমার আওতায় পড়ে না। এসব সমস্যা সমাধানে গাড়ির কোম্পানি বা শো-রুম ওয়ারেন্টি দেয়। মদ্যপ অবস্থায় ড্রাইভিং, বেপরোয়া গতিতে চালানো, বৈধ লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানো, অযত্নের কারণে ক্ষতি, ইত্যাদি কারণে কোনো ক্ষতি হলে গাড়ি বীমায় আওতায় পড়বে না। ওভারলোডের কারণে গাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হলে, তা বীমার আওতায় পড়বে না।
৪. কী কী কারণে বীমা কোম্পানি ক্লেইম বাতিল করতে পারে
ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি, ট্যাক্সি কিংবা সার্ভিস ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হলে, তা বীমার আওতায় পড়বে না। এছাড়া ইচ্ছাকৃত ক্ষতি কিংবা ভুল তথ্য প্রমাণিত হলে, বীমা কোম্পানি ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে না। গাড়ি দুর্ঘটনায়, চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলে, কিংবা চালক মদ্যপ অবস্থায় থাকলে, কোম্পানি ক্লেইম বাতিল করতে পারে। মাদক কিংবা অবৈধ কোনো কিছুর কারণে, গাড়ি জব্দ করা হলে, এবং এর ফলে গাড়ির কোনো ক্ষতি হলে, বীমা কোম্পানি ক্লেইম বাতিল করতে পারে।
৫. ক্ষতিপূরণ ক্লেইম করার পদ্ধতি
যেকোনো দুর্ঘটনা কিংবা হারিয়ে গেলে দ্রুত বীমা কোম্পানিকে অবহিত করুন। নিকটস্থ থানায় জিডি করে কপিসহ বীমা কোম্পানিকে জমা দিতে হবে।। বীমা কোম্পানি গাড়ি পরিদর্শন এবং ক্ষয়ক্ষতি নির্ণয় করবে। গাড়ি পরিদর্শন শেষে বীমা কোম্পানির অনুমোদিত নির্দিষ্ট গ্যারেজে গাড়ি পাঠাতে হবে। আপনার পলিসি অনুযায়ী নির্দিষ্ট বিল বীমা কোম্পানি পরিশোধ করবে অথবা ক্যাশলেস ক্লেইম অফার করবে।
বীমা করার আগে যে সব বিষয় যাচাই করবেন
-গাড়ির বর্তমান বাজার মূল্যের উপর প্রিমিয়াম কত হবে তা নির্ভর করে। পুরোনো কিংবা ব্যবহৃত গাড়ি কিনলে, প্রিমিয়াম কম দেবার জন্য গাড়ির দাম খুব কম দেখাবেন না। কারণ কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতিপূরণও কম পাবেন।
-নির্দিষ্ট বীমা পলিসিতে বাড়তি কিছু বিষয় যোগ করা যায়। এটাকে অ্যাড-অন কভার বলে। যেমন, বন্যা, ভূমিকম্প, ইত্যাদি। আপনি যে অঞ্চলে বসবাস করেন, সেই অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগ পরিস্থিতি বিবেচনা করে অ্যাড-অন কভার বেছে নিন।
-বিভিন্ন কোম্পানির পলিসি তুলনা করুন। কোম্পানির ক্লেইম সেটেলমেন্ট রেশিও কেমন চেক করুন। ডেপ্রিসিয়েশন মেজারমেন্ট পলিসি চেক করুন।
-বীমা পলিসিতে ক্যাশলেস গ্যারেজ সুবিধা আছে কিনা দেখুন। এর ফলে বীমা কোম্পানির তালিকাভুক্ত গ্যারেজে সাভিসিং কিংবা মেরামত করলে, এটির খরচাপাতি বীমার আওতায় আসবে। কিংবা বিশেষ ছাড়ের সুবিধা পাবেন।
-বীমা পলিসিতে নো ক্লেইম বোনাস সুবিধা আছে কিনা দেখুন। এই সুবিধার আওতায়, আপনি যদি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দুর্ঘটনার জন্য কোনো ক্লেইম না করেন, তাহলে পরবর্তী প্রিমিয়ামে ছাড় পাবেন।
-বীমা পলিসি কেনার আগে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, ট্যাক্স টোকেন, ফিটনেস সার্টিফিকেট, জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স করে রাখতে হবে।
পরিশেষে
বাংলাদেশে সব ধরনের মোটর যানবাহনের বীমা বাধ্যতামূলক। গাড়ির ক্ষেত্রে ন্যূনতম থার্ড-পার্টি লায়াবিলিটি বীমা থাকা প্রয়োজন। বীমা ছাড়া গাড়ি চালালে জরিমানা সহ আইনি জটিলতার মুখে পড়বেন। শুধুমাত্র আইনি বাধ্যবাধকতার জন্য নয়, বরং নিরাপত্তা এবং আর্থিক ঝুঁকি কমাতে, সঠিক বীমা পলিসি বেছে নিন। ইন্স্যুরেন্স বা বীমা পলিসি কেনার সময় অনেকেই বিভ্রান্তিতে পড়েন। পলিসির শর্তাবলী এবং ক্লেইম প্রক্রিয়া ভালোভাবে বুঝে নিন। আপনার প্রয়োজন এবং সুবিধা অনুযায়ী পলিসি বাছাই করুন।
সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী
১. বাংলাদেশে গাড়ির বীমা কি বাধ্যতামূলক?
বাংলাদেশে গাড়ি সহ সকল ধরণের মোটর যানবাহনের জন্য বীমা বাধ্যতামূলক। বীমা ছাড়া গাড়ি চালালে জরিমানা গুনতে হবে।
২. কম্প্রিহেনসিভ বীমা কী কী কভার করে?
এই বীমা পলিসি নিজের গাড়ির ক্ষতি, চুরি, আগুন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি কভার করে, সাথে অন্য পক্ষের কোন ক্ষতি হলে সেটিও কভার করে।
৩. গাড়ির বীমা প্রিমিয়াম কী কী বিষয়ের উপর নির্ভর করে?
গাড়ির ধরন, ইঞ্জিন সিসি, ফুল ইনসিওর্ড ভ্যালু (এফআইভি), অ্যাড-অন, ড্রাইভিং রেকর্ড, কেমন পরিবেশে রেগুলার ড্রাইভ করেন, ড্রাইভারের বয়স, চালকের অভিজ্ঞতা, ইত্যাদি বিষয়ের উপর প্রিমিয়াম নির্ভর করে।
৪. নো ক্লেইম বোনাস কী?
এই সুবিধার আওতায়, আপনি যদি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দুর্ঘটনার জন্য কোনো ক্লেইম না করেন, তাহলে পরবর্তী প্রিমিয়ামে ছাড় পাবেন। এই বিশেষ ডিসকাউন্ট কে নো ক্লেইম বোনাস বলা হয়।
৫. গাড়ির বীমা কেনার জন্য কী কী ডকুমেন্টস লাগে?
বীমা পলিসি কেনার আগে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, ট্যাক্স টোকেন, ফিটনেস সার্টিফিকেট, জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স করে রাখতে হবে।




































